ভাগ্য গণনাকারীরা হাত দেখে ভাগ্য বলে দিতে পারে—এমন বিশ্বাস হয়তো কারও কারও আছে। কিন্তু চিকিৎসকেরা হাত দেখে বুঝতে পারেন রোগের লক্ষণ। হাতের বর্ণ-চেহারা-নখ ইত্যাদি আপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ধারণ করে। আপনার হাতই হয়তো বলে দিতে পারে অনেক কিছু।
হাত মেলানো মন্দ নয়: চিকিৎসকের সঙ্গে হাত মেলানোর মাধ্যমেও হয়তো জানা যাবে অনেক কিছু। যেমন: হাইপার থাইরয়েড, অতি উদ্বিগ্ন রোগীর হাত ঘামে ভেজা থাকে, হাতে কাঁপুনি থাকতে পারে।
আবার হাইপোথাইরয়েড রোগীর হাত থাকে খসখসে। হাতের তাপমাত্রাও অনুভব করা যাবে এর মাধ্যমেই। আপনি একজন ধূমপায়ী কি না, তা-ও বোঝা যাবে আপনার আঙুল ও নখের রং দেখেই। আপনার আঙুলের ফাঁকে সংক্রমণ থাকলেও তা নজরে আসবে সহজে।
নখের আছে নানা রং: দেহে স্বাভাবিক রক্ত থাকলেই সাধারণত নখের রং গোলাপি হয়। নখ দেখতে যদি ফ্যাকাশে ও প্রাণহীন লাগে, তবে রক্তস্বল্পতা আছে বলে ধরা যায়। ডায়াবেটিস বা যকৃতের রোগেও নখ ফ্যাকাশে হয়। নখ হলুদ এবং শক্ত ও মোটা হয়ে গেলে বুঝতে হবে, আপনার নখে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়েছে। নখে সাদা সাদা ছোপ পড়তে পারে কিডনির সমস্যায় বা আমিষের অভাবে। নখের নিচে ও কোণে নিলচে রং হলে বুঝতে হবে যথেষ্ট অক্সিজেনের সরবরাহ নেই দেহে। হাঁপানি রোগী বা ফুসফুস ও হৃদ্রোগীদের ঠোঁট বা নখ নীল হয়ে এলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন।
ভঙ্গুর নখ: অনেকের অল্পতেই নখের আগা ভেঙে যায়। নখে বা হাতে বেশি পানি লাগালে নখ ভঙ্গুর হয়ে যায়। এ ছাড়া বারবার নখ ভেঙে যাওয়া পুষ্টিহীনতা বা রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার লক্ষণ। নখের কোণের ত্বক লাল ও ফোলা হতে পারে সংক্রমণের কারণে। একে প্যারোনাইকিয়া বলে। আবার সোরিয়াসিসের রোগীদের নখে গর্ত গর্ত থাকতে পারে।
আঙুল ফুলে কলাগাছ? নখ ও আঙুলের মাঝে একটা কৌণিক ব্যবধান থাকার কথা। এই কোণ নষ্ট হয়ে গেলে তাকে বলে ক্লাবিং। ফুসফুস ও হৃদ্যন্ত্রের নানা জটিল রোগে এ ক্লাবিং হতে দেখা যায়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীদের হাতে কয়েক রকমের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় যেমন, আঙুল হয়ে যায় বাঁকা। আবার বাতের নানা সমস্যায় হাতের বিভিন্ন সন্ধি ফুলে যেতে পারে। হাতের বিভিন্ন স্নায়ুর সমস্যাও বোঝা যাবে হাতের আকৃতি দেখেই।
এসব ছাড়াও ত্বকের ও সন্ধির নানা রোগ, শিশুদের ডাউনস সিনড্রোম (অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অস্বাভাবিক আকৃতি) ও নানা রকমের ক্যানসারের গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ বলে দেয় আপনার হাত। [১]
হাত দেখে স্বাস্থ্য গণনা
হাত দেখে ভাগ্য গণনা করেন জ্যোতিষীরা। সেটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। তবে হাতের অবস্থা দেখে স্বাস্থ্য গণনার বিষয়টি বিজ্ঞানসম্মত। আপনার হাতের অস্বস্তির লক্ষণ দেখে নিজেই অনুমান করতে পারবেন স্বাস্থ্যের অবস্থা। সমাধানও আছে। তবে সব সমস্যা ও সমাধানের ব্যাপারে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ক্লান্তি ও অবসাদ
কীভাবে বুঝবেন: ভারী কিছু তুললে হাতের চামড়া–সংলগ্ন স্নায়ুতে চাপ পড়ে। এমনটা হয় হাতের কবজি বেকায়দায় থাকলেও। আর এর ফলে হাতের আঙুলগুলোতে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়।
যা করতে হবে: পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান ও বিশ্রাম নিন। ম্যাসাজ নিলেও উপকার হবে।
রক্তসঞ্চালনে সমস্যা
কীভাবে বুঝবেন: ডান হাতের আঙুলের ডগা অসাড় লাগতে পারে বেশ কিছু কারণে। তার মধ্যে আঙুলের চামড়া–সংলগ্ন স্নায়ুতে চাপ, হাত কিংবা কাঁধের সন্ধিস্থলের আঘাত অন্যতম। কার্ডিওভাসকুলার অসুখের কারণে রক্ত ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না। ফলে ডান হাতের আঙুলে অস্বস্তি হতে পারে।
যা করতে হবে: নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। হাঁটুন, দৌড়ান, ব্যায়াম করুন। এর ফলে শরীরের সব জায়গায় রক্তসঞ্চালন ত্বরান্বিত হবে। তবে সবার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।
ভিটামিনের অভাব
কীভাবে বুঝবেন: কিছু ভিটামিনের (যেমন ‘ই’, ‘বি১ ’, ‘বি৬’ এবং ‘বি ১২ ’) অভাবে বাঁ হাত অথবা বাঁ পায়ের আঙুলে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়।
যা করতে হবে: ভিটামিনের অভাব পূরণ করুন। ভিটামিন নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অতিরিক্ত ভিটামিন শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মেরুদণ্ডের সমস্যা
কীভাবে বুঝবেন: মেরুদণ্ডের অনেক সমস্যার কারণে বাঁ হাতের অনামিকা ও কনিষ্ঠায় অস্বস্তি হতে পারে। মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণে আঙুলের স্নায়ুতেও চাপ পড়ে আর এর ফলেই আঙুলে অস্বস্তি হয়।
যা করতে হবে: সুযোগ পেলেই আড়মোড়া ভাঙুন। মেরুদণ্ড একটু বাঁকা করুন। যোগব্যায়াম ও শরীরচর্চা করতে পারেন। সাঁতারেও উপকার হয়। দীর্ঘক্ষণ একটানা বসে থাকা যাবে না।
ডায়াবেটিস
কীভাবে বুঝবেন: পা থেকে শুরু করে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হাতের তালু ও আঙুল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শরীরের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে রক্তসঞ্চালনের মাত্রা কমে গেলে এমনটা হয়। আর রক্তসঞ্চালনের মাত্রা হ্রাস পায় স্নায়ুর শীর্ষ ভাগগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে।
যা করতে হবে: টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের বেলায় চিকিৎসকেরা ইনসুলিনের পরামর্শ দেন। টাইপ টু ডায়াবেটিসের বেলায় অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসই মূল কারণ। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করলে সমাধান মিলে যায়।
কারপাল টানেল সিনড্রোম
কীভাবে বুঝবেন: এ সমস্যার কারণে হাতের বুড়ো আঙুল, তর্জনী কিংবা মধ্যমা অসাড় লাগতে পারে। ঝিমঝিমও করতে পারে। কর্মক্ষেত্রে বা দৈনন্দিন জীবনে আমাদের হাত অনেক সময় ক্রমাগতভাবে চলতে থাকে। এর ফলেই এমনটা হয়।
যা করতে হবে: নিয়ম করে সাধারণ কিছু ব্যায়াম করতে পারেন। কাজের ফাঁকেই কবজি দুটি একটু ঘুরিয়ে, টানটান করে ব্যায়ামগুলো করা যায়। [২]
হাত দেখে স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানবেন যেভাবে
নিত্যদিনের সব কাজ করতে হাতই আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা। সারাদিন প্রায় সবরকমের কাজেই আমরা হাতের ব্যবহার করে থাকি।এই হাত আমাদের ব্যক্তিত্বের জানান দেয়। আবার হাত দেখিয়েই আমরা আমাদের ভূত-ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে পারি। তবে জানেন কি, হাত আপনার স্বাস্থ্যেরও সুলুকসন্ধান দিতে পারে, তাও আবার নিঁখুতভাবে। যেমন হাত দেখে থাইরয়েডের সমস্যা, হরমোনের সমস্যা, পেটের নানা সমস্যা সম্পর্কে জানা যায়। আপনার হাত কীভাবে শরীরের সম্পর্কে জানায় তা নিচে দেয়া হল।
১. লাল হাত : আপনার হাতের তালু যদি সবসময়ে লাল হয়ে থাকে তাহলে পেটের রোগে ভোগার সম্ভাবনা প্রবল। ফ্যাটি লিভার, সিসোরিসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গেত বহন করে লাল হাতের তালু। তবে গর্ভধারণের সময়ে হাতের তালু লাল হয়ে থাকে, তাতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
২. আঙুলের দৈর্ঘ্য: মেয়েদের অনামিকা যদি তর্জনীর চেয়ে বড় হয় তাহলে তাদের অস্টিওপরোসিসে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ছেলেদের সাধারণভাবে তর্জনীর চেয়ে অনামিকা লম্বার বড় হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিক।
৩. স্ফীত আঙুল: যদি আপনার আঙুল প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্ফীত ও শক্ত হয়, তাহলে থাইরয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা রয়েছে। অনেক সময়ে মেটাবলিজমের হার কমে গেলে শরীর ফুলতে থাকে। নানা জায়গায় ফ্লুইড জমতে থাকে। হাতেও তার প্রভাব পড়ে।
৪. ফ্যাকাশে নখ: যদি আপনার নখ ফ্যাকাশে হয়, এবং চেরে ধরার পর বেশ কিছুক্ষণ সাদা হয়েই থাকে, তাহলে বুঝবেন আপনি অ্যানিমিক হয়ে পড়েছেন। শরীরে আয়রনের খামতি হলে নখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
৫. নখের নিচের দিকে লাল ছোপ: নখের নিচের দিকে যদি লাল বা গাঢ় বাদামি ছোপ দেখতে পান তাহলে সাবধান। রক্তে কোনও কারণে সংক্রমণ হলে অথবা হার্টের অসুখ হলে এমন হয়ে থাকে।
৬. মোটা ও গোল আঙুলের ডগা: এমন আঙুলের অধিকারীদের ফুসফুস ও হার্টের সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ফলে কোনওরকম সমস্য়া দেখলে অবশ্যই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৭. নীল আঙুলের ডগা: ধূসর অথবা নীল রঙের আঙুলের ডগা হলে বুঝবেন রক্তের প্রবাহ ঠিকমতো হচ্ছে না। এমন হলে হাত ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ও আঙুলে অসারতা হতে পারে।
৮. হাতের উপরের অংশে লাল ছোপ: হাতের উপরের অংশে অর্থাৎ তালুর উল্টোদিকে যদি লাল ছোপ থাকে, তাহলে তা ডায়বেটিসের লক্ষণ। কারণ এতে আক্রান্তদের রক্তকণিকা ও নার্ভ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শরীরের ভিতরে রক্তরাত হয়ে এমন হয়ে থাকে। [৩]
হাতের কব্জির ব্যথায় কী করবেন?
কব্জির ব্যথা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। হঠাৎ ইনজুরির কারণে কব্জিতে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে। মচকে গেলে কিংবা হাড় ভাঙলে কব্জিতে বেশ ব্যথা হয়। তবে অনেক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার জন্য কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, যেমন—বারবার কব্জিতে চাপ, বাত ও কারপাল টানেল সিনড্রোম।
যেহেতু অনেক কারণে কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, তাই কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদি কব্জির ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। সঠিক রোগ নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার ওপর নির্ভর করে আপনার কব্জির ব্যথার সঠিক চিকিৎসা।
কব্জির ব্যথার উপসর্গ কেমন হয়?
কব্জির ব্যথার উপসর্গ বিভিন্ন ধরনের হয়। এটি নির্ভর করে ঠিক কী কারণে ব্যথা হচ্ছে, তার ওপর। যেমন—অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ব্যথা ঠিক ভোঁতা ধরনের দাঁতব্যথার মতো, অথচ টেনডনের প্রদাহ বা টেনডিনাইটিসের ব্যথা সাধারণত তীক্ষ্ণ ও ধারালো ধরনের।
আপনার কব্জির ব্যথার স্থানটি নির্ভুলভাবে দেখাতে পারলে ব্যথার কারণ খুঁজে বের করা সহজ হবে।
কব্জির ব্যথার কারণগুলো কী?
আপনার কব্জি বা রিস্টজয়েন্ট হলো একটি জটিল সন্ধি, যা তৈরি হয়েছে কয়েকটি হাড়ের সমন্বয়ে, যেমন—রেডিয়াস ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং আটটি ছোট ছোট কারপাল হাড়। এই কারপাল হাড়গুলো দুই সারিতে সাজানো। লিগামেন্টের শক্ত ব্যান্ড আপনার কব্জির হাড়গুলোকে একে অন্যের সঙ্গে, আপনার রেডিয়াম ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং আপনার হাতের হাড়গুলোকে সংযুক্ত করে। টেনডনগুলো হাড়ের সঙ্গে মাংসপেশিকে সংযুক্ত করে। আপনার কব্জির যেকোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথা হতে পারে এবং আপনার হাত ও কব্জির ব্যবহারের সক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কব্জির ব্যথার সাধারণ কারণগুলো নিচে বর্ণিত হলো :
১. ইনজুরি
হঠাৎ সংঘর্ষ: হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলে আপনার কব্জিতে খুব বেশি ইনজুরির ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে কব্জি মচকে যায়, কব্জিতে টান পড়ে এবং কব্জির হাড় ভেঙেও যায়। কব্জির বুড়ো আঙুলের দিকে হাড়টির নাম স্কাফয়েড। এটি অনেক সময় ভেঙে যায়। এ ধরনের হাড় ভাঙলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা এক্স-রেতে নাও দেখা যেতে পারে। ব্যথা অনেক দিন থাকে, কব্জি নাড়াচাড়া করলে ব্যথা বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে হাত দিয়ে কাজ করা যায় না। প্লাস্টার করেও ব্যথার উপশম হয় না। অপারেশন করতে হয়। অনেক সময় স্কাফয়েড হাড় ভাঙলে হাড়ের মধ্যে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় এবং হাড়ের জোড়া লাগতে সমস্যা হয়। যার ফলে ব্যথা হয় এবং কব্জি নাড়তে অসুবিধা হয়। তখন অপারেশনের প্রয়োজন হয়।
হাতের ওপর ভর দিয়ে পড়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলিস ফ্রাকচার হয়। এ ক্ষেত্রে রেডিয়াসের নিচের অংশ ভেঙে যায়। কব্জি ফুলে যায়।বারবার চাপ
কব্জি বারবার নাড়াতে হয় এমন যেকোনো কাজে টেনিস বল খেলা থেকে শুরু করে কিংবা বেহালা বহন করতে করতে কব্জির সন্ধির চারপাশের টিস্যুতে প্রদাহ হতে পারে কিংবা হাড় ভেঙে যেতে পারে। বিশেষ করে কোনো বিরতি ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কব্জির কাজ করলে। বারবার চাপের ফলে হাতের কব্জির ব্যথার আরেকটি কারণ হলো ডি কোয়ার ভেইন’স ডিজিজ। এ ক্ষেত্রে কব্জির বাইরের দিকে, অর্থাৎ রেডিয়াসের ওপর দিয়ে যে দুটো টেনডন বিন্যস্ত রয়েছে, তাদের আবরণীতে প্রদাহ হয়। ব্যথা বুড়ো আঙুলের মূলে অনুভূত হয়।
ডি কোয়ার ভেইন’স ডিজিজে কব্জি নাড়াতে খুব ব্যথা হয়, কাজ করতে অসুবিধা হয় এবং অনেক সময় কাজের পর ব্যথা বেশ বেড়ে যায়। বুড়ো আঙুলে চাপ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
২. আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা
অস্টিওআর্থ্রাইটিস: সাধারণত কব্জিতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস খুব কম হয়। কোনো লোকের কব্জিতে আগে ইনজুরি হয়ে থাকলে পরে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়। এ ক্ষেত্রে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ছিঁড়ে যায় বা ক্ষয় হয়। বুড়ো আঙুলের মূলে ব্যথা হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার নিজস্ব টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। কব্জিতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়। যদি একটি কব্জি আক্রান্ত হয়, তাহলে সাধারণত অন্য কব্জিতেও এটি ঘটে।
৩. অন্যান্য রোগ ও অবস্থা
কারপাল টানেল সিনড্রোম: আপনার কব্জির তালুর দিকের অংশে একটি পথ রয়েছে, যার নাম কারপাল টানেল; এর মধ্য দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ অতিক্রম করে। মিডিয়ান নার্ভে চাপ পড়লে কব্জি ও হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ অবস্থার নাম কারপাল টানেল সিনড্রোম।
গ্যাংলিয়ন সিস্ট: কব্জির ব্যথার অন্যতম কারণ হলো এক ধরনের টিউমার জাতীয় ফোলা বস্তু থাকে, যাকে গ্যাংলিয়ন বলে। এটি ওঠে টেনডনের আবরণী থেকে কব্জির পেছনে অথবা সামনের দিকে। স্থানটি ফুলে ওঠে। কব্জি নাড়ালে ব্যথা হয়। বড় গ্যাংলিয়ন সিস্টের চেয়ে ছোটগুলো বেশি ব্যথা সৃষ্টি করে।
কিয়েনবক’স ডিজিজ: এটি সাধারণত তরুণদের হয়। এ ক্ষেত্রে কব্জির লুনেট নামের ছোট হাড়টিতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে হাড়টি কোলাপস করে। লুনেট হাড়ের ওপরে চাপ দিলে ব্যথা লাগে এবং রোগী হাত মুঠো করে ধরতে পারে না।
কব্জি ব্যথার ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো কী? যে কারো হাতের কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, তা আপনি অল্প কাজ করুন কিংবা বেশি কাজ করুন না কেন। কিন্তু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের কারণে এ ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। যেমন—
খেলাধুলা করা: বিভিন্ন খেলাধুলায় কব্জিতে ইনজুরি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বোলিং, গলফ, জিমন্যাস্টিক, টেনিস প্রভৃতি।
বারবার কাজ করা: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাত ও কব্জির যেকোনো কাজ বারবার করলে কব্জির ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। যেসব মহিলা হাঁড়ি-পাতিল ধোয়াধুয়ি করেন বা বুননের কাজ করেন (যেমন সোয়েটার বোনা), তাঁদের কব্জির ব্যথা বেশি হয়। যাঁরা চুল কাটার কাজ করেন, তাঁদেরও কব্জির ব্যথা বেশি হয়।
যাঁরা কম্পিউটার কিবোর্ডে টাইপ করেন, কম্পিউটার মাউস ব্যবহার করেন, হ্যান্ডবল খেলেন, সেলাই করেন, আঁকাআঁকি করেন, লেখালেখি করেন বা ভাইব্রেটিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, তাঁদের কব্জির ব্যথা বেড়ে যায়।
রোগ: যদি আপনার ডায়াবেটিস, লিউকেমিয়া, স্কে-রোডার্মা, লুপাস থাকে কিংবা থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করে, তা হলে আপনার কব্জির ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
কোন ধরনের ডাক্তার দেখাবেন: প্রাথমিকভাবে আপনার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের সঙ্গে আলাপ করুন। তিনি আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যেমন—রিউমাটোলজিস্ট, স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কিংবা অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে পারেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে আপনি আপনার উপসর্গের বিস্তারিত বর্ণনা দেবেন, আপনার কোনো রোগ আছে কি না জানাবেন, আপনার বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের অন্য রোগ আছে কি না জানাবেন, আপনি কোনো ধরনের ওষুধ খেতে থাকলে তা বলবেন, কী ধরনের খাবার গ্রহণ করেন তা জানাবেন এবং চিকিৎসক যা যা জানতে চাইবেন তার সঠিক উত্তর দেবেন।
কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবেন: আপনার কব্জিতে ব্যথা হলেই প্রথমত আপনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। তিনি আপনাকে প্রথমে শারীরিক পরীক্ষা করবেন। আপনি কব্জির কোথায় চাপ দিলে ব্যথা অনুভব করেন, তা পরীক্ষা করে দেখবেন। কোনো ফোলা আছে কি না, তা দেখবেন। চিকিৎসক আপনার কব্জির নাড়াচাড়ার মাত্রাটা দেখবেন। আপনি শক্ত হাতে ধরতে পারেন কি না দেখবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি আপনাকে কব্জির এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, বোন স্ক্যান ও এমআরআই করতে দিতে পারেন। যদি এসব পরীক্ষায় কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে আপনার চিকিৎসক আপনাকে আর্থ্রাস্কোপি ও নার্ভ টেস্ট করে দেখতে পারেন।
চিকিৎসা: হাতের কব্জির ব্যথার চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ভর করে ইনজুরির ধরন, স্থান ও তীব্রতা সর্বোপরি আপনার বয়স ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। প্রথমত, আক্রান্ত হাতের কব্জিকে বিশ্রামে রাখতে হবে এবং যদি কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণে কব্জিতে ব্যথা হয়ে থাকে, তাহলে তার উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ, যেমন—আইবুপ্রফেন ও অ্যাসিটামিনোফেন কব্জির ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। প্রয়োজনে শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। হাড় ভাঙলে হাড়ের টুকরোগুলো সঠিক বিন্যাসে রাখতে হবে, যাতে ঠিকমতো জোড়া লাগে; এ ক্ষেত্রে কাস্ট বা স্পিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
কব্জিতে টান লাগলে বা মচকে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত টেনডন বা লিগামেন্ট যাতে সুরক্ষা পায়, সে জন্য স্পিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রান্ত হাতের কব্জিকে নড়াচড়া থেকে রক্ষা করার জন্য রিস্টব্যান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হয়। যেমন—মারাত্মকভাবে হাড় ভাঙলে, কারপাল টানেল সিনড্রোমের উপসর্গ তীব্র হলে এবং টেনডন বা লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে।
একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, সব ধরনের কব্জির ব্যথায় কিন্তু মেডিকেল চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কব্জিতে সামান্য আঘাত পেলে আপনি আঘাতের স্থানে বরফ লাগালে উপকার পাবেন এবং আক্রান্ত কব্জিতে ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ পরে থাকবেন।
হাতের কব্জির ব্যথা কীভাবে প্রতিরোধ করবেন: হাতের কব্জিতে ব্যথা ঘটায় এমন কোনো কোনো বিষয় প্রতিহত করা বেশ মুশকিল, তবে সুরক্ষার জন্য কিছু টিপস মেনে চললে উপকার পাবেন।
হাড় শক্ত করে গড়ে তুলুন: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম খান। ৫০ বছরের ওপরের মহিলারা প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার ২০০ মিলিগ্রাম অথবা বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খান। এতে করে হাড়ভাঙা প্রতিহত হতে পারে।
পড়ে যাওয়া ঠেকান: বেশির ভাগ কব্জির ব্যথার প্রধান কারণ হলো হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে পড়ে যাওয়া। পড়ে যাওয়া ঠেকাতে উপযুক্ত জুতা পরুন। ঘরের জঞ্জাল দূর করুন। ঘরদোর আলোকিত রাখুন। প্রয়োজনে বাথরুমে ধরার জন্য গ্রাব বার এবং সিঁড়িতে হ্যান্ডরেইল লাগান।
খেলাধুলা করার জন্য সুরক্ষাকর ব্যবস্থা নিন: যাঁরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত, যেমন—ফুটবল, স্কেটিং ইত্যাদি, তাঁরা রিস্টগার্ড পরে নেবেন।
পেশাগত ব্যাপারে সতর্ক হোন: যাঁরা দীর্ঘ সময় কিবোর্ডে কাজ করেন, তাঁরা নিয়মিত বিশ্রাম নেবেন। টাইপ করার সময় আপনার কব্জিকে রিল্যাক্স রাখবেন, নিউট্রাল পজিশনে রাখবেন। আর্গোনমিক কিবোর্ড এবং ফোম বা জেল রিস্ট সাপোর্ট ব্যবহার করুন। বারবার কাপড় মোচড়ানো, হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা কিংবা হাতের কব্জিকে বারবার ঘোরাতে হয় এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকুন।
[১] অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ [২] ব্রাইটসাইড [৩] অনলাইন ডেস্ক [৪] ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
কমেন্টস করুন