আপনার সোনামণির যত্নে আপনার চেষ্টার কোথাও কমতি থাকেনা। মায়ের মন বলে কথা! তবে বাচ্চাদের ত্বকের যত্নে না জেনে আমরা বেশকিছু ভুল করে ফেলি। এর প্রভাবে বাচ্চাদের ত্বকে রুক্ষতা, র্যাশ সহ নানান সমস্যা দেখা দেয়। তাই আজ আমরা জানাব বাচ্চাদের ত্বকের যত্নে কমন ৫টি ভুলের কথা।
বেশি গোসল করানো অথবা পরিষ্কার করা: বাচ্চা একটু হয়তো ধুলো লাগল, বা হয়তো প্যান্টেই হিসু করে দিয়েছে। আর আপনি সাথে সাথে বাচ্চার গা ধুইয়ে ফেললেন।
ভাবলেন, যাক! জীবাণুর হাত থেকে বাঁচানো গেল!
কিন্তু বাচ্চার ত্বক সংবেদনশীল। বার বার ধোয়া হলে এটি আপনার বেবির ত্বক শুষ্ক এবং রুক্ষ করে ফেলবে। তাই প্রয়োজন ছাড়া বার বার বাচ্চার ত্বক পরিষ্কার করার অভ্যাস বাদ দিন। প্রতিদিন একবার গোসল করানোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথেষ্ট।
ঠান্ডা লেগে যাবার ভয়ে গোসল/পরিষ্কার কম করানো: অনেকের ধারণা বাচ্চাদের নিয়মিত গোসল করাবার দরকার নেই। দেখা যাচ্ছে দু-তিন দিন পর পর একবার গোসল করাচ্ছেন। বাকি সময় বড়জোর গা মুছে দিচ্ছেন।
এটাও ভুল!
বাচ্চা সারাদিন ঘরে থাকলেও ঘাম ময়লা তো জমবেই। তাই গোসল নিয়মিত বাচ্চাকে গোসল করান। ঠান্ডার দিনে বাচ্চাকে হাল্কা গরম পানি দিয়ে গোসল করাবেন। তবে এটা অবেলায় করাবেন না। রোদ উঠে যাবার পর থেকে দুপুর হবার আগ পর্যন্ত (অর্থাৎ সকাল ১০ টা থেকে ১২টা) হচ্ছে বেস্ট টাইম।
বড়দের সাবান ব্যবহার: আমরা অনেকেই বাচ্চাকে প্রতিদিন বাচ্চাকে সাবান দিয়ে গোসল করাই। আপনি কি জানেন যে বড়দের সাবানে থাকে অতিরিক্ত ক্ষারীয় উপাদান?
শিশুদের ত্বক বড়দের তুলনায় ৫ গুণ পাতলা। বেবির সংবেদনশীল ত্বকে বড়দের সাবান ব্যবহারে শিশুর ত্বকে র্যাশ, রুক্ষ, অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। শিশুর ত্বকে উপযোগী সাবান (যা অবশ্যই ময়েশ্চারাইজারযুক্ত হতে হবে) ব্যবহার করুন।
বড়দের প্রোডাক্ট ব্যবহার করানো: বাসায় লোশন আছে একটাই। সেটা হয়তো আপনার (মায়ের) জন্য কেনা। আর এটাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন বাচ্চার জন্য।
আপনি হয়তো জানেন না, বড়দের প্রসাধন সামগ্রীতে চড়া মাত্রায় প্রিজারভেটিভ, পারফিউম, এবং এলারজেন উপাদান থাকে। যা আপনার বাচ্চার কোমল ত্বকের জন্য কোন অবস্থাতেই উপযোগী নয়।
এছাড়া বাচ্চাদের ত্বক বড়দের তুলনায় দ্রুত শুষ্ক হয়ে পড়ে তাই ওর দরকার এমন বেবি লোশন যা কয়েকগুণ বেশি ময়েশ্চারাইজিং।
তবে বাসায় যদি একটাই লোশন রাখতে হয় তাহলে সেটা বেবি লোশনই যেন হয়। কারণ, বেবি লোশন আপনিও ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু বাচ্চা তো আর বড়দেরটা ব্যবহার করতে পারবেনা।
অপরিশোধিত তেল মাখানো: সরিষার তেল, তিলের তেল ইত্যাদি আগের দিনে বাচ্চাদের মাখিয়ে তারপর গোসল করানো হত।
আমরা বাচ্চাদের ত্বকে তেল ব্যবহার করার বিপক্ষে নই। কারন, গোসলের আগে তেল ম্যাসাজ করা বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং স্বাভাবিক গ্রোথের জন্য উপকারী।
কিন্তু আমাদের দেশের এই তেল গুলো অপরিশোধিত [RAW] এবং ক্ষেত্রবিশেষে ফিল্টারড ও নয়।
এসব তেলে থাকতে পারে ঝাঁজালো উপাদান এবং উচ্চমাত্রায় এসিড ভ্যালু যা বাচ্চার ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। তাই ব্যবহার করুন এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ অলিভ অয়েল। এতে কোন ঝাঁজালো বা সংবেদনশীল উপাদান নেই। বিশ্বজুড়ে ডাক্তাররা এক্সট্রা ভার্জিন গ্রেড অলিভ ওয়েলকেই বাচ্চাদের জন্য বেস্ট ম্যাসাজ ওয়েল বলে রেকমেন্ড করেন।
পরিশিষ্ট: বাচ্চাদের ত্বকের যত্নে শুধু একটা জিনিস মনে রাখলেই আপনার জন্য এটি করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।আর সেটি হল এই যে আপনার এবং আপনার বেবির ত্বক এক নয়। তাই যা কিছু আপনি নিজের জন্য করছেন, বাচ্চার জন্য তাই করবেন এমন না।
কোমল ত্বকের যত্ন কোমলভাবেই নিন। আর এড়িয়ে চলুন বড়দের পণ্য, বাচ্চা বড় না হওয়া পর্যন্ত।[১]
শিশুর ত্বকে সমস্যা ও লক্ষণ
শিশুর ত্বকে বিভিন্ন রকম সমস্যা হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ডা. মো. রোকন উদ্দিন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চর্ম ও যৌন বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন: শিশুদের ত্বকে কী ধরনের সমস্যা হয়?
উত্তর: শিশুদের ত্বক বড়দের ত্বকের থেকে একটু আলাদা। ওদের সমস্যাগুলো কিছুটা আলাদা হয়। সাধারণত বাচ্চারা বিভিন্ন ভাইরাল রোগ, ব্যাকটেরিয়াল রোগ, ফাঙ্গাল রোগ-এগুলোতে বেশি ভোগে। এতে বড় একটি দল ভোগে। আর কিছু ছোঁয়াচে অসুখ, যেমন-স্ক্যাবিজ হতে পারে। এ ছাড়া কিছু জন্মগত ত্রুটি, যেমন-ডার্মাটোসিস, ল্যাকেমপেনাস বা অন্যান্য রোগে ভুগতে পারে। একদম ছোট বাচ্চারা, যেমন-নবজাতক, এরাও কিছু রোগে ভোগে।
প্রশ্ন: শিশু চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে, সেটা কী কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে?
উত্তর: এটিতে যাওয়ার আগে বাচ্চাদের ত্বক কেন আলাদা, আমি সেটি একটু বলে নিই। বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের চামড়া পাতলা। আমাদের বাইরের আবরণ যেটা সাধারণত সুরক্ষায় কাজ করে, বাইরের ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ঢুকতে দেয় না—সেই আবরণ প্রায় ৩০ ভাগের মতো পাতলা। এতে সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু ঢুকতে পারে।
দুই নম্বর সমস্যা হলো, বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এতে সহজেই সংক্রমণ হয়ে যায়। কোনো একটি জায়গা চিরে গেল বা ফেটে গেল, এতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে না, তবে বাচ্চাদের সমস্যা হচ্ছে। অনেক ব্যাকটেরিয়াল ইনফরমেশন আমার হচ্ছে, তবে আমার পাশের আরেকজনের হচ্ছে না। বাচ্চাদের মধ্যে এটা কিন্তু একজন থেকে আরেকজনের ক্ষেত্রে ছড়াচ্ছে। কারণ, বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা রয়েছে। এটা এমন যে মায়েরা যখন বাচ্চার চোখে সমস্যা হচ্ছে, তখন চোখের চিকিৎসক দেখাচ্ছেন। কানে যখন সমস্যা হচ্ছে, কানের চিকিৎসক দেখাচ্ছেন। তবে যখন চামড়ায় সমস্যা হচ্ছে, চামড়ার চিকিৎসকরা প্রথম অবস্থায় দেখতে পান না, অন্য চিকিৎসকরা দেখেন। এই জায়গাটায় বাচ্চাদের মা-বাবার অবশ্যই একটু সচেতন হতে হবে। চোখের চিকিৎসক হলে যদি চোখের চিকিৎসক দেখানো হয়, চামড়ার চিকিৎসায় চামড়ার চিকিৎসক কেন নয়? আরেকটি বিষয় হলো, সমস্যাগুলো রোগভেদে একেক সময় একেকভাবে প্রকাশিত হবে। সব যে একই রকম হবে, তা নয়। তবে বেশিরভাগ শিশুই ভোগে এটোপিক ডার্মাটাইটিস রোগে।
প্রশ্ন: লক্ষণগুলো কী?
উত্তর: এটোপিক ডার্মাটাইটিস হচ্ছে আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তার প্রভাবে বাচ্চাদের চামড়ার মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হওয়া। এই বাচ্চার মায়েরা কিন্তু বলছেন, আমার বাচ্চাকে মশা কামড় দিলে ওই জায়গাটা ফুলে যায়। অনেক সময় পেকে যায়। আবার বাচ্চার যেই জায়গাগুলো খোলা থাকে, যেমন—হাত-পা, সেই জায়গাগুলো কালো হয়ে যাচ্ছে বা দুদিন পরপর সেখানে সংক্রমণ হয়ে যাচ্ছে। আবার বাচ্চা যে পানি ধরছে বা সাবান ধরছে, তাতেও সমস্যা হচ্ছে।
কেবল ধুলাবালি, সাবান, পানি, ঘাম—এতে যে সমস্যা হবে, সেটি কিন্তু নয়। আমরা ভদ্রলোক হওয়ার জন্য কিছু জিনিস করে ফেলেছি। যেমন ডায়াপার ব্যবহার করার জন্য ডায়াপার ডার্মাটাইটিস বলে একটা অসুখ তৈরি হয়েছে, এটা তো আগে ছিল না। এসি আসার জন্য, কার্পেট ব্যবহার করার জন্য, ধুলাবালি হওয়ার জন্য বিভিন্ন মাইট আমরা ঘরের মধ্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমাদের ছোটবেলায় এগুলো ছিল না। এতে এই জিনিসগুলোও আমাদের এটোপিক ডার্মাটাইটিসকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে এটোপিক ডার্মাটাইটিসের খাবারের সঙ্গেও সম্পর্ক আছে বা থাকতে পারে। আমি বলব, মা-বাবারা যেন খাবারের দিকে নজর দেন।
ধুলাবালি, ঘাম, সাবান, পানি ইত্যাদি অসুখকে বাড়িয়ে দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সংক্রমণ হয়, চুলকানি হয়। বাচ্চাগুলোর প্রধান সমস্যা চুলকানি এবং রাতে ঘুমাতে পারে না। তার ঘুমের অসুবিধা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা যদি এই বাচ্চাগুলোর দিকে নজর না দিই, বাচ্চাগুলোর মস্তিষ্ক বৃদ্ধির সময় তিন বছর পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাগুলো রাতে ঘুমাতে পারবে না। পর্যাপ্ত ঘুম হবে না। বাচ্চাগুলো বিরক্ত থাকবে। বৃদ্ধিটা ঠিকমতো হবে না। শেষ পর্যন্ত একটা হাবাগোবা বাচ্চা পাব। বাচ্চাটা হয়তো ভালো একটি বাচ্চা ছিল, কিন্তু সামান্য সচেতনতার অভাবে দেখা গেছে একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমি বলছি, আমার বাচ্চাটা বুদ্ধিমান ছিল, তবে যত বয়স হচ্ছে সে বোকা হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলোতে অবশ্যই বাবা-মায়ের সচেতন হওয়া উচিত। কারণ, ঘুম খুব জরুরি বাচ্চাদের জন্য। ঘুমের অসুবিধা খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। স্কুলের ফলাফল খারাপ করাবে। বাচ্চা বিরক্ত হয়ে যাবে। [২]
সঠিক যত্নে আজীবন সুস্থ রাখুন শিশুর ত্বক
শৈশব থেকেই শিশুর ত্বকের যত্ন নিলে তা আজীবন সুস্থ ও সতেজ থাকতে পারে। তাছাড়া এতে চর্মরোগের ভয় যেমন দূর হয়, তেমনই নানা অসুখও প্রতিরোধ হয়। কিন্তু ঠিক কিভাবে শিশুর ত্বকের যত্ন নিতে হবে সেটা জানেন তো?
শিশু মানেই নানা বেবি প্রোডাক্টের উপর নির্ভর করে থাকা। শিশুর শ্যাম্পু, সাবান, পাউডার, তেল ইত্যাদি কেনার আগে এর উপাদান পড়ুন মন দিয়ে। এতে কোনও টক্সিক পদার্থ থাকলে তা অবশ্যই এড়িয়ে চলুন। যে সব শিশু সে ভাবে বেবি প্রোডাক্টের উপর নির্ভর করতে পারে না, তাদের জন্যও প্রসাধন বাছুন খুব সাবধানে।
কেবল হাড়ের জোর নয়, শিশুর ত্বকের যত্নের অন্যতম উপায় তেল মালিশ করা। তার ত্বকের প্রতিটা রন্ধ্রে তেল পৌঁছনো খুব জরুরি। নামী সংস্থার তেল হোক বা সাধারণ পরিচর্যার কোনও তেল— চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তা মাখান শিশুকে। এবং মাখানোর পদ্ধতিও এমন রাখুন য়াতে শরীরের সব অংশ সমান তেল পায়।
একটা সময়ের পর থেকেই শিশুকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে কিছু ফলের রস খাওয়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এই অভ্যাস শুধুমাত্র শিশুর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাই বাড়ায় না, বরং বেদানা, কালো জাম, কমলালেবু, গাজর ইত্যাদির রস তার ত্বকেরও যত্ন নেয়।
শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টে ভর্তি বাদাম রাখুন সন্তানের খাদ্যতালিকায়। কাজুবাদাম, কাঠবাদাম ও সাধারণ বাদামে থাকা তেল ছোটদের চামড়ার জন্য উপকারী।
কেমিক্যালমুক্ত নানা ঘরোয়া প্যাক লাগাতে পারেন শিশুর শরীরে। শিশুর ত্বকের ধরন বুঝুন আগে। তার পর মুলতানি মাটি, কলা, মধু, চন্দন, পাকা পেঁপে, দই ইত্যাদির মধ্যে কোনগুলো প্রয়োজন তা বুঝে তার জন্য প্যাক বানাতে পারেন। তবে অতিরিক্ত প্যাকে অনেক সময় সন্তানের ঠান্ডা লাগে। এই দিকে খেয়াল রাখবেন।
সেলুন কিংবা পার্লারে শিশুর যে কোনও পরিচর্যার সময় নজর রাখুন ব্যবহৃত যন্ত্র ও উপাদানের উপর। যন্ত্রগুলি যেন পরিষ্কার ও জংবিহীন হয়। ত্বকে সংক্রমণ হয় এমন কোনও সুযোগ তৈরি হতেই দেবেন না। শিশুর চামড়া ও শরীরের পক্ষে ক্ষতি করবে এমন উপাদান থেকেও দূরে রাখুন তাকে।
শীতে শিশুর ত্বকের যত্ন ও দৈনন্দিন পরিচর্যা
শিশুদের ত্বক খুবই স্পর্শকাতর হওয়াতে শীতকালে শিশুদের নরম ত্বক জলীয়বাষ্প হারিয়ে ফেলে শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে ওঠে তার সাথে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। তাইতো আমাদের ছোট্ট সোনামনিদের শীতের শুষ্ক ও রুক্ষ পরিবেশে ত্বকের জন্য চাই বিশেষ যত্ন। এই শুষ্ক মৌসুমে শিশুর বাবা মাকে থাকতে হবে বিশেষ সতর্ক আর মূল কথা হলো শীতে শিশুর ত্বকের যত্ন নিতে বাড়তি প্রস্ততির কোন বিকল্প নেই। শীতে শিশুর ত্বকের কোমলতা ও ময়েশ্চারাইজার এর ভারসাম্য ঠিক রাখা আসলেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মনে রাখবেন শিশুর ত্বক যেমন বড়দের ত্বক থেকে ভিন্ন ঠিক তেমনি শিশুর ত্বকের যত্ন নেয়ার পদ্ধতিও ভিন্ন। আসুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে শীতে শিশুর ত্বকের যত্ন নিয়ে শুষ্কতা, রুক্ষতা ও চর্ম রোগের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
আসলে শীতে শিশুর ত্বকের যত্ন তার দৈনন্দিন পরিচর্যার বিষয় গুলোর মধ্যেই একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে সেরে ফেলা সম্ভব। আর এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে শিশুর ত্বক থাকবে কোমল এবং আপনি থাকবেন নিশ্চিন্ত। আশাকরি নিচের বিষয় গুলো পড়ে আপনি পেয়ে যেতে পারেন শীতে শিশুর ত্বকের সমস্যার সমাধান।
শীতে শিশুর গোসল: শীতকালে শিশুকে গোসল করাতে হবে হালকা গরম পানি দিয়ে কেননা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করালে যেমন ঠান্ডা লেগে যাবার ভয় থাকে পাশাপাশি বেশি গরম পানি দিয়ে গোসল করালেও ত্বকের আর্দ্রতা হারিয়ে যায়। সুতরাং শিশুর ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে ও ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা করতে গোসলে ব্যবহার করুন কুসুম গরম পানি। তবে শীতকালে ২ বছরের কম বয়সি শিশুকে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে এক দিন পর পর গোসল করালেই শিশুর ত্বক ভালো থাকবে।
শিশুর ত্বকোপযোগী সাবান: শিশুর গায়ে সাবান ব্যবহারে অনেক সতর্ক থাকুন কারন শিশুদের ত্বক বড়দের তুলনায় ৫ গুণ পাতলা। আর সাবান দিয়ে গোসল করালে সাবান যেন ময়েশ্চারসমৃদ্ধ ও শিশুর ত্বকের উপযোগী হয়। যে সাবানের পিএইচ মাত্রা শিশুর ত্বকের পিএইচ মাত্রার সমান, সে রকম সাবান শিশুর ত্বকের জন্য উপযোগী। সেই সাথে তার শরীর পরিস্কারে অবশ্যই বেবি সোপ ব্যবহার করুন এবং কিছুতেই বড়দের সাবান লাগানো যাবেনা কারন বড়দের সাবানের উপাদান তার ত্বক আরো বেশি শুষ্ক করে ফেলে ও শিশুর ত্বকে র্যাশ, অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে।
শিশুর ত্বক উপযোগী তেলের ব্যবহার: শিশুদের দেহে তেলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সব ধরনের তেল শিশুদের জন্য উপযোগী নয়। বাচ্চাদের মাথার ত্বকে এক্সট্রা ভার্জিন গ্রেড নারকেল তেল অল্প পরিমাণে ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া শিশুকে নিয়মিত অলিভ অয়েল দিয়ে মাসাজ করতে পারেন। শিতকালে শিশুর ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী উপাদান হোয়াইট সফট প্যারাফিন বা ফসপোলিপিড সমৃদ্ধ ময়েশ্চারাইজার শিশুর ত্বকের জন্য উপকারী। শিশুকে অলিভ অয়েল বাথও দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এক বালতি পানিতে পাঁচ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন। এতেও শিশুর ত্বক নরম হবে। এ ছাড়া গোসলের পরও ভেজা ত্বকে অলিভ অয়েলের সঙ্গে সামান্য পানি মিশিয়ে শিশুর শরীরে ম্যাসাজ করে লাগান। ভালো ময়েশ্চারাইজারের কাজ করবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি লিনোলেইক অ্যাসিড-সমৃদ্ধ তেল ব্যবহার করা যায়। এটি একধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড, যা ত্বকের সুরক্ষা দেয়। সূর্যমুখী তেলে এটি বেশি থাকে। যাদের একজিমা আছে, তাদের অলিভ অয়েল ব্যবহার না করাই ভালো।
লক্ষণীয় ত্বকের রোগ: সাধারনত এক বছরেরও কম বয়সি শিশুদের ইনফ্যানটাইল সেবোরিক ডার্মাটাইটিস নামের এক ধরনের ত্বকের রোগ হয়ে থাকে। এসময় শিশুদের মাথায় অনেক খুশকি হয় সেই সাথে গলায়, বগলে, থাইয়ের খাঁজে, ন্যাপি এরিয়ায় লাল লাল দাগ ও হতে পারে। অনেক সময় চামড়া উঠতে শুরু করে ও মাঝেমধ্যে রস বের হয়। এ সমস্যা দূর করতে শিশুর মাথায় ও চুলে নিয়মিত নারিকেল তেল বা অলিভ অয়েল লাগান। নবজাতকের মাথায় দুই থেকে তিন মাস তেল বা অলিভ অয়েল লাগালে এর নিরাময় হয়। আর ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কিটোকোনিজল বা জিঙ্ক পাইরেথিওনসমৃদ্ধ শ্যাম্পু দিয়ে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার শিশুর চুল পরিষ্কার করুন।
শীতের রুক্ষ আবহাওয়ার কারণে শিশুর ত্বক অনেক সময় অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যায় তখন একজিমার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। বারবার হাঁচি হতে পারে, যাকে বলা হয় অ্যালার্জিক রাইনাইটিস যা শিশুদের মধ্যে বংশগতভাবেও হয়ে থাকে। ত্বকে প্রদাহ হলে শিশুরা প্রায়ই আক্রান্ত জায়গাগুলো নখ দিয়ে চুলকায়। ফলে চামড়া উঠে যায় এজন্য শিশুর নখ নিয়মিত কেটে রাখুন আর ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মলমজাতীয় ওষুধ আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করুন।
শীতে শিশুর পোশাক: শিশুর কাপড়চোপড় সাবান দিয়ে ধোয়ার পর পরিষ্কার পানিতে বারবার চুবিয়ে সম্পূর্ণ সাবানমুক্ত করে শুকানো উচিত। কারণ, সাবানের ক্ষারযুক্ত শুকনো কড়কড়ে কাপড় শিশুর নরম ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। সেইসাথে শিশুর পরিধেয় পোশাক অবশ্যই নরম ও মসৃণ হতে হবে। শিশুর পোশাক খসখসে ও অমসৃণ হওয়া উচিত নয় বরং সুতির হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ, ত্বকের জন্য সুতির কাপড়ই সবচেয়ে নিরাপদ। শীতকালে গরম কাপড়ের নিচে অবশ্যই একটি সুতি জামা পরাবেন।শীতের পোশাকের নিচে হালকা সুতির পোশাক পরানো হলে শিশু স্বস্তি পাবে।
বর্জনীয় বিষয়: শিশুর শরীরের সরিষার তেল মাখাবেন না, সরিষার তেল শিশুর ত্বকের জন্য উপযোগী নয়। কারণ এই তেল মাখলে ত্বক চিটচিটে হয়ে যায়। ফলে ধুলাবালি সহজে ত্বকে আটকে যায়। আবার ঘন বলে এই তেল লোমকূপ বন্ধ করে দিয়ে সংক্রমণও ঘটাতে পারে। সরিষার তেল থেকে ফুসকুড়ি বা প্রদাহ হতে পারে। সরিষার তেল মাখিয়ে বাচ্চাকে রোদে রাখার যে প্রচলিত রীতি আছে তা একেবারেই অনুচিত। এতে ত্বকের পিগমেন্টেশন বেড়ে যায় এবং শিশু কালো হয়ে যায়। শিশুদের আদৌ তেল মাখার প্রয়োজন আছে কি না, এ নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতের ভিন্নতা আছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, খুব ছোট শিশুদের, অর্থাৎ নবজাতকদের শরীরে তেল মাখালে তা লাভের চেয়ে ক্ষতিই করে বেশি। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে গায়ে তেল মাখেনি এমন বাচ্চাদের ত্বক বেশি মজবুত। আসলে আমাদের ত্বকের ওপরের পাতলা আবরণের নিচেই চর্বি বা ফ্যাটের স্তর থাকে। তেল মাখলে এই চর্বির স্তর পাতলা হয়, অর্থাৎ সুগঠিত হয় না। এর ফলে শিশুর শরীর সহজে শীতল হয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া ত্বকে সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। একটু বড় বাচ্চাদের অবশ্য তেল মাখা যাবে।[৩]
[১] অনলাইন ডেস্ক [২] ডা. মো. রোকন উদ্দিন, চর্ম ও যৌন বিভাগ, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল [৩] ডিএইচডি
কমেন্টস করুন